Thursday, September 11, 2025
বাঙালি কাউন্টডাউন
HomeScrollFourth Pillar | গণতান্ত্রিক ভারতের জেলেই পচে মরবে উমর খালিদ, শরজিল ইমাম?

Fourth Pillar | গণতান্ত্রিক ভারতের জেলেই পচে মরবে উমর খালিদ, শরজিল ইমাম?

এর থেকে অনেক বেশি জঘন্য অপরাধ করার পরেও ১ বছরে ৯ বার প্যারোল পাচ্ছেন রামরহিম

উমর খালিদ এবং শরজিল ইমাম—দু’জনই গত পাঁচ বছর ধরে বিচারহীন অবস্থায় জেলেই রয়েছেন। ২০২০ সালের দিল্লি দাঙ্গার তথাকথিত ‘বৃহত্তর ষড়যন্ত্র’ মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার এতদিন পরেও তাঁদের বিচার এখনও শুরুই হয়নি, অথচ তাঁরা বছরের পর বছর ধরে জেলে পচছেন। সন্ধ্যের কলতলার আসরে এই নিয়ে কোনও খবর নেই। কারণ উমর খালিদ, শরজিল ইমামদের সঙ্গে যাঁরা জেলে, তাঁরা সব্বাই মুসলমান। ল্যাটা চুকে গেল! সরকার তো কেবল মুসলমানদেরই জেলে পুরছে, আমাদের কী? এই ভেবে যাঁরা বসে রয়েছেন, তাঁদের বলি, এই সরকারের আনা যাবতীয় ‘কালা কানুন’গুলোর কোথাও লেখা নেই যে, সেগুলো হিন্দুদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হবে না। হ্যাঁ শুরুয়াতটা হয়েছে সংখ্যালঘু মুসলমানদের দিয়ে, কিন্তু তা ওখানেই থামবে এমনটা কে বলেছে? একটু খেয়াল করে দেখুন বেশ কিছু আইন এর মধ্যেই পাশ করা হয়েছে বা হবে, সেই তালিকার বেশিরভাগই বিভিন্ন অপরাধের জন্য জেল-হাজতের কড়াকড়ির কথা বলছে। আনা হচ্ছে নতুন সমাজ মাধ্যমের আইন, যেখানে আপনার লেখা দেশ, দেশের সন্মান, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির বিরুদ্ধে গেলেই আপনাকে জেলে পোরা হবে। হ্যাঁ, জেলে তো পোরা হবে, কিন্তু আমি কোন সংস্কৃতির বিরোধিতা করেছি, কেন করেছি তা কীভাবে বিচার হবে? কেন? যেভাবে রাম জন্মভূমির রায় বেরিয়েছে। গোটা রায়ের ভিত্তি হল আস্থা। না, দেশের সংবিধান আইন কানুন নয়, কিছু মানুষের আস্থা। কাজেই আবার আপনি সেই কিছু মানুষের আস্থাকে অসন্মান করেছেন, তাই আপনাকে জেলে পাঠানো হতেই পারে। হ্যাঁ, সেই আইন আনা হচ্ছে। আনা হচ্ছে উগ্রপন্থার সমর্থন, সাহায্য আর যোগাযোগের আইন, আর তার প্রমাণের সংশোধন। একটা ডায়রির কাগজে আপনার নাম আছে, যে ডায়রিটা নাকি এক উগ্রপন্থীর মৃতদেহের কাছ থেকে পাওয়া গিয়েছে। ব্যস, আপনি জেলে! হ্যাঁ, সেই আইন আসছে। ডায়রি তৈরি করা যায়, আর সেখানে আপনার নাম ফোন নম্বর লিখে সেটাকে রেখে আসতে কতই বা সময় নেবে? আসছে নতুন আইন, যেখানে আন্দোলন প্রতিবাদের ফলে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির ক্ষতি হলে এমনকি যাবজ্জীবন জেলের ব্যবস্থাও থাকছে। সেই আইনে সেই প্রতিবাদীর বাড়ি-ঘর-দোর, তার অভিভাবকদের চাকরি, সবই কেড়ে নেওয়া যাবে। এছাড়া তো আছেই আরও কত শত আইন। আজ যা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার হচ্ছে, কাল তা প্রতিবাদীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে। তারপর তা নিশ্চিতভাবে সমস্ত বিরোধীদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করা হবে, কেবল সময়ের অপেক্ষা।

অন্যদিকে, এর থেকে অনেক অনেক বেশি জঘন্য অপরাধ করার পরেও রামরহিম এক বছরে নয় বার প্যারোল পায়, আশারাম বাপু ধর্ষণের দায়ে শাস্তি পাওয়ার পরেও শারীরিক কারণেই জেলের বাইরে, কারণ তাঁর শিষ্যদের মধ্যে আছেন মোদি–শাহ। অনিল আম্বানি ৩০০০ কোটি টাকার ফ্রডের পরেও জেলের বাইরে। উমর খালিদ শরজিল ইমাম, মীরন হায়দার, সাফোরা জারগার, খুররাম পারভেজরা জেলে আছেন। পাঁচ বছর ধরে জেলে পচছেন ‘দিল্লি রায়ট’-এ অভিযুক্ত এই ছেলেমেয়েরা। আর এটাই তো তাদের জন্য শাস্তি যা ভারতের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার কংকালসার চেহারাটাকে সামনে নিয়ে আসে। এই প্রক্রিয়াকেই ‘Process as Punishment’ বলেছেন ভারতের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এনভি রামানাও। এটাই বেআইনি কার্যকলাপ (প্রতিরোধ) আইন, বা UAPA-এর মতো আইনেরই এক স্বাভাবিক পরিণতি, পরিকল্পিত ফল। প্রতিবাদের কণ্ঠস্বরকে চুপ করিয়ে দিতে রাষ্ট্রকে এক দানবীয় ক্ষমতা দিয়েছে এই আইন। এবং লক্ষ্য করে দেখুন, এর প্রথম এবং প্রধান শিকার প্রায়শই এক নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মানুষজন। ২০২০ সালের ‘দিল্লি দাঙ্গা’র মূল ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে অভিযুক্ত উমর খালিদ এবং শরজিল ইমামের বিরুদ্ধে UAPA ছাড়াও আরও কিছু ধারায় মামলা করা হয়েছে। প্রসিকিউশনের দাবি, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারত সফরের সময় দিল্লিকে আন্তর্জাতিকভাবে হেয় করার জন্য এক সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে দাঙ্গার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এই দাঙ্গা কোনও স্বতঃস্ফূর্ত ঘটনা ছিল না, এটা নাকি ছিল এক এক সুপরিকল্পিত অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অংশ। কিভাবে বুঝলেন? মানে এই কথাগুলোর সমর্থনে কোন কোনও প্রমাণ আছে? আরে বাবা, প্রমাণের কথা তো তখন আসবে যখন বিচার শুরু হবে। গত পাঁচ বছর ধরে বিচারই শুরু হয়নি, কিন্তু দিল্লি হাইকোর্ট বারবার তাঁদের জামিনের আবেদন খারিজ করে দিয়েছে। হাইকোর্ট বলেছে UAPA-এর মতো আইনের মামলাতে অনেকদিন ধরে জেলে আছে তাই জামিন চাই, তেমনটা হতেই পারে না। অতএব পাঁচ বছর বিচার শুরু হয়নি, তাঁরা জেলে বন্দি। সবচেয়ে বড় কথা হল, সেই বিচার শুরু না হওয়ার পিছনে প্রসিকিউশনের কৌশলগত ভূমিকা রয়েছে। প্রসিকিউশন ২২,০০০ পৃষ্ঠারও বেশি বিশাল চার্জশিট জমা দিয়েছে, যেখানে ১৮ জন অভিযুক্ত এবং অসংখ্য সাক্ষী জড়িত।

আরও পড়ুন: Fourth Pillar | এবারে বিজেপির প্রবীণ নেতাও প্রকাশ্যেই নেমে পড়লেন মোদিজির বিরুদ্ধে

আর UAPA এর ধারা 43D(5)-এ বলা আছে, যদি চার্জশিটে ‘prima facie true’ বা ‘আপাতদৃষ্টিতেও সত্যি’ বলে মনে হয়, তাহলে আদালত অভিযুক্তকে জামিন দিতে বাধ্য নয়। একদম সেই সুযোগটা নিয়েই প্রসিকিউশন এই বিশাল আর জটিল চার্জশিট পেশ করে বিচার শুরু হওয়াকে বিলম্বিত লয়ে এনে ফেলতে পেরেছে। অথচ একই সঙ্গে আদালতকে জামিন অস্বীকার করার জন্য প্রয়োজনীয় ‘prima facie true’ প্রমাণও দেখাতে পেরেছে। ফলে তাঁরা একদিকে জামিনও পাচ্ছে না, অন্যদিকে বিচার শুরু না হওয়ায় নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করার সুযোগও পাচ্ছে না। এর উপর ২০১৯ সালে সুপ্রিম কোর্টের Watali মামলার রায় এই ধারাটাকে আরও কঠোর করেছে, যা জামিন পাওয়াকে কার্যত অসম্ভব করে তুলেছে। UAPA-র আইনি সংজ্ঞার অস্পষ্টতা রাষ্ট্রকে এক চরম ক্ষমতা প্রদান করেছে। এই আইনে ‘বেআইনি কার্যকলাপ’ এবং ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’-র সংজ্ঞা অত্যন্ত বিস্তৃত আর অস্পষ্ট। এই অস্পষ্টতার সুযোগে রাষ্ট্র শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ, যেমন ‘চাকা জ্যাম’ (রাস্তা অবরোধ) বা রাজনৈতিক পরিকল্পনার মতো বিষয়কেও ‘সন্ত্রাসী কার্যকলাপ’ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে। একবার এই তকমা লেগে গেলে, Watali রায়ের অধীনে জামিন পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়। যার ফলে রাষ্ট্র বিচারের ঝামেলা ছাড়াই অন্য মতের ভিন্ন মতের মানুষজনকে বছরের পর বছর জেলে আটকে রাখতে পারে। এটা সংবিধানের মৌলিক অধিকার, বাক স্বাধীনতা এবং জীবন ও স্বাধীনতার অধিকারকে সম্পূর্ণভাবে নিষ্ক্রিয় করে দেয়, যা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য মারাত্মক হুমকি। এবং এই বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, নির্বিচার গ্রেফতার এবং জামিন পেতে অসুবিধার কারণেই অভিযুক্তদের জীবনের মূল্যবান সময়, স্বাধীনতা এবং সম্মান চিরতরে নষ্ট হয়ে যায়।

উমর খালিদের পাঁচ বছরের কারাবাস এই ধারণার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। এমনকি যদি তিনি শেষ পর্যন্ত সব অভিযোগ থেকে খালাসও পান, জীবনের এই মূল্যবান সময়টুকু আর কখনও ফিরে পাবেন না, যা এক অপূরণীয় ক্ষতি। যা কেবল অভিযুক্তের ব্যক্তিগত জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না, বরং তা সমাজের উপরও এক গভীর প্রভাব ফেলে। তাঁরা বছরের পর বছর জেলে থাকেন, তখন সমাজ তাঁদের সন্দেহের চোখে দেখে। গণমাধ্যম এবং রাজনৈতিক বক্তৃতার মাধ্যমে তাঁদের বিরুদ্ধে ‘ষড়যন্ত্রকারী’ বা ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে এক জনমত তৈরি করা হয়। যেমন এক্ষেত্রে তাঁদের এক কল্পিত ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’-এর সদস্য বলে স্ট্যাম্প মারা হয়েছে। এই কারাবাস এবং জনসমক্ষে মানহানি এক স্পষ্ট বার্তা দেয়, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কথা বললে বা প্রতিবাদ করলে এই পরিণতি ভোগ করতে হবে। যা নাগরিক সমাজে এক ধরনের ভয়ের জন্ম দেয়, যা তাদের কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে দেয় (‘chilling effect’) । গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য মুক্ত আলোচনা, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা সীমিত হয়ে পড়ে, যা এক সুস্থ গণতন্ত্রের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। উমর খালিদ ও শরজিল ইমাম বা এই মামলাতে গ্রেফতার অন্যান্যদের মামলা কেবল কটা মানুষের এক চরম দুর্ভোগের গল্প নয়, এটা ভারতের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের জন্য এক অগ্নিপরীক্ষা। এই পুরো প্রক্রিয়াটা উমর খালিদ এবং শরজিল ইমামদের মামলার এই টানতে থাকা এই দীর্ঘসূত্রিতাকেই এক চরম শাস্তিতে পরিণত করেছে, যা ভারতের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার ভয়ঙ্কর দুর্বলতাকে তুলে ধরে। UAPA-র মতো ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার বয়ে নিয়ে চলা আইন কীভাবে ভিন্নমতকে, প্রতিবাদকে দমন করছে, কীভাবে আইনের শাসনকে দুর্বল করছে এবং রাষ্ট্র কীভাবে প্রতিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের মধ্যের সীমারেখাকে ইচ্ছাকৃতভাবে মুছে দিচ্ছে—এই সবই গণতন্ত্রের জন্য এক মারাত্মক বিপদ। আর আপাতত এর মধ্যেও সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হল, এই পুরো প্রক্রিয়ায় এক নির্দিষ্ট সম্প্রদায় বারবার লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে। UAPA-র মতো কঠোর আইনের পক্ষপাতদুষ্ট ব্যবহার এক নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মধ্যে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করছে এবং তাঁদের সাংবিধানিক অধিকারকে সীমিত করে দিচ্ছে। যদি বিচার ব্যবস্থা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা উদ্বেগের কাছে নতিস্বীকার করে, তাহলে নাগরিক অধিকার, বাক স্বাধীনতা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ঝুঁকির মুখে পড়বে, প্রশ্নের মুখে পড়বে। এই মামলাটা এক জরুরি প্রশ্ন তুলছে, আমরা কি এক এমন সমাজ চাই যেখানে নাগরিক অধিকার সুরক্ষিত থাকবে, নাকি এমন এক সমাজ যেখানে রাষ্ট্রের আইনই সর্বোচ্চ এবং ভিন্নমত সহ্যই করা হবে না?

Read More

Latest News